ব্যান্ড BANNED?
বাংলা ব্যান্ড এখনও জনপ্রিয়। তবু টিভি, এফ এমে আর শোনাই যাচ্ছে না তাদের গান। কেন এমন? উত্তর খুঁজেছেন প্রিয়ম সেনগুপ্ত।
ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘লাভ ইট অর হেট ইট, বাট ইউ কান্ট ইগনোর ইট’। বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ক্ষেত্রেও কিন্তু সেই কথাটা খাটে। নিন্দুকেরা বলতেই পারেন, বাংলা ব্যান্ডের সে পুরনো জৌলুস আর নেই। সত্যিই কি তাই? বাজারি প্রচারের মাপকাঠিতে যদি ধরা হয়, তা হলে আপাতদৃষ্টিতে এরকমটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। ১৯৯৮-’৯৯ থেকে শুরু করে বাংলা ব্যান্ড জাঁকিয়ে বসেছিল কলকাতা–সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে।
ব্যান্ড ছাড়া কলেজ ফেস্ট? ভাবাই যেত না। একটা সময় ছিল, যখন পাঁচটা সংস্কৃতিমনস্ক ছেলে এক জায়গায় হলে লিটল ম্যাগাজিন বের করার কথা ভাবত। নব্বইয়ের শেষে এবং দু’হাজারের শুরুর দিকে সেভাবেই পাঁচজন সংস্কৃতিমনস্ক এক জায়গায় হলেই তৈরি হয়েছে ব্যান্ড। তার সবকটাই যে বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে এমন নয়। তবে আবার বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখেছে, এমন ব্যান্ডের সংখ্যাও কম নয়। না হলে কেনই বা ব্যান্ড-এ-মাতরম্ কিংবা ব্যান্ডওয়াগনের মতো শো-গুলো আয়োজন করবে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল? কেন বাংলা ব্যান্ডের গান নিয়ে আলাদা ‘স্লট’ রাখবে কলকাতার এফ এম স্টেশনগুলো? তার মানে কিছু নিশ্চয়ই ছিল ব্যান্ডের গানে। তা হলে ছবিটা পাল্টাল কেন?
সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একটু চোখ রাখা যাক বাংলা ব্যান্ডগুলোর কনসার্টের দিকে। খুব কম কনসার্টই আছে, যেখানে বাংলার প্রথম সারির ব্যান্ড পারফর্ম করতে উঠলে হাউসফুল বা প্রায় হাউসফুল ভিড় হয় না। এই ২০১৬-তে (যে সময়টাকে বাংলা ব্যান্ডের মন্দার বাজার বলা হচ্ছে) এসেও অডিটোরিয়াম উপচে পড়া ভিড় কীসের ইঙ্গিত দেয়? জনপ্রিয়তা ছাড়া কীভাবে ব্যাখ্যা করব এই ছবিকে, যেখানে স্টেজে উঠে জনপ্রিয় ব্যান্ডের জনপ্রিয়তম গায়ক যখন হুঙ্কার ছাড়েন, ‘বসে বসে রক শো হয় না’ তখন ব্যারিকেড ভেঙে হুড়মুড়িয়ে স্টেজের সামনে চলে আসেন দর্শক-শ্রোতারা। নিজের চোখে এই দৃশ্যগুলো দেখলে কেউই বলতে পারবেন না, যে বাংলা ব্যান্ড জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। আসলে যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে বাংলা বেসিক অ্যালবাম (যা সাধারণভাবে সোলো অ্যালবাম নামেও পরিচিত) এবং বাংলা ব্যান্ডকে একঘরে করে রেখেছে রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো।
১০-১৫ বছর আগের কথা ভাবুন। বাংলা ফিল্মের গানের পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়ে মিউজিক চ্যানেল এবং এম এম স্টেশনগুলোতে নিয়মিত বাজানো হত। রমরমিয়ে চলতও সেগুলো। তখনও ইন্টারনেট এবং ইউটিউবের এতটা বাড়বাড়ন্ত হয়নি। শুনতে চাই বললেই দুম করে পছন্দের ব্যান্ডের গান ডাউনলোড করে শুনে নেওয়া যেত না। ভরসা তাই সেই এফ এম আর টিভি চ্যানেলগুলোই। অজস্র শ্রোতা হাপিত্যেশ করে থাকতেন কখন সঙ্গীত বাংলায় ‘একলা ঘর’-এর নতুন ভিডিওটা দেখাবে। কখন রেডিও মির্চির বিশেষ শো ‘বেতার মির্চি’-তে ‘লক্ষ্মীছাড়া’ আনপ্লাগড গাইবে ‘জীবন চাইছে আরও বেশি’। ওই একই শো-তে ফসিলস এপিসোড তো ব্যান্ড ইতিহাসের লোকগাথায় ঢুকে গেছে। সেসময় এফ এম আর টিভি চ্যানেলগুলোতে নিয়ম করে বাজানো হত কবীর সুমন, মৌসুমি ভৌমিক, নচিকেতাদের গান। সঙ্গে অবশ্যই বাংলা ব্যান্ড। কিন্তু যত দিন এগিয়েছে, ততই এফ এম স্টেশন আর মিউজিক চ্যানেলগুলোতে জাঁকিয়ে বসেছে ফিল্মের গান। এই মুহূর্তে ফিল্মের গানের বাড়বাড়ন্তের কারণটা এক ‘ওপেন সিক্রেট’। রেডিও কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলের অন্দরমহলে খোঁজ নিলেই জানা যায়, ফিল্ম প্রোডাকশন হাউসগুলো কীভাবে তাদের হাতের পুতুল করে রেখেছে। কলকাতা শহরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি রেডিওকর্মীর আক্ষেপ, তাঁরা কবীর সুমন, নচিকেতাদের পাশাপাশি বাংলা ব্যান্ডের গানও সমান গুরুত্ব দিয়ে বাজাতে চান। কিন্তু সেই অনুমতি কর্তৃপক্ষ দেন না। বরং প্লে-লিস্টে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ফিল্মের গান। কারণ, নিজেদের ফিল্মের গান বাজানোর শর্তে আগে থেকেই ‘স্লট’ কিনে রেখেছে প্রোডাকশন হাউসগুলো। ফলে ব্যান্ডের জন্য সময় নেই।
কলকাতার এক নামজাদা রেডিও জকি বলছিলেন, ‘গানও এখন অনেকটাই বাজারের আর পাঁচটা পণ্যের মতোই। বাজারে নতুন পণ্য আনার আগে তার বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটিংয়ের ওপরে জোর দেওয়া হয়। গানের মার্কেটিংটা হয় এফ এম স্টেশনে বারবার বাজিয়ে সেটাকে সুপরিচিত করে তোলার মাধ্যমে। মুম্বইয়ের গানের বাজারে এই ফর্মুলা অনেক আগেই প্রয়োগ করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ভাবে সেটা সফলও হয়েছে। শ্রোতারা কোন গান শুনবেন, অর্থের জোরে সেটা ঠিক করে দিচ্ছেন অর্থবান প্রোডিউসাররা। ফলে তাঁদের প্রযোজনা করা ফিল্মের গানই বারবার বাজছে রেডিও স্টেশনে। এবার বোধহয় কলকাতার পালা। আস্তে আস্তে কলকাতার রেডিও স্টেশনগুলোও ফিল্মের প্রোডিউসারদের হাতের পুতুল হয়ে যাবে। তখন ইচ্ছে না থাকলেও আমাদের বাংলা ব্যান্ড বা কবীর সুমনের গান না বাজিয়ে, যতই বলো আমায় বোকা ভোলা, কাল হবি তুই আমার কোকাকোলা— জাতীয় গান বাজাতে হবে।’ একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, কলকাতায় একটা রেডিও স্টেশন ইতিমধ্যেই ১০০ শতাংশ হিন্দি গান বাজাতে শুরু করেছে। ১০০ শতাংশ হিন্দি গান— অর্থাৎ কলকাতার বুকে ব্যবসা করতে নেমেও একটিও বাংলা গান প্লে-লিস্টে না রাখার সিদ্ধান্ত! বাংলা গানকে ব্রাত্য করে দেওয়ার এই প্রচেষ্টা কতটা সমর্থনযোগ্য, সে বিচার শ্রোতারাই করবেন। তবে মজার তথ্য হচ্ছে, এই স্টেশনগুলোই যখন স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করতে একটি লাইভ শো-র আয়োজন করে, তখন ডাক পড়ে সেই প্লে-লিস্টে ব্রাত্য থাকা বাংলা ব্যান্ডগুলোরই। তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে, ফসিলস, ক্যাকটাস, চন্দ্রবিন্দুদের গান অনুষ্ঠানে বাজানো যায় না। কিন্তু তাদের আয়োজন করা লাইভ–শো সুপারহিট করতে বাংলা ব্যান্ডেরই শরণাপন্ন হতে হয়। এরপরেও যখন কোনও এফ এম চ্যানেলের প্রতিনিধি বলে দেন, ‘বাংলা ব্যান্ড জনপ্রিয়তা হারিয়েছে’, তখন বিষয়টা ‘ধাঁধার চেয়েও জটিল’ বলেই মনে হয়। স্টেজ শো-তে আছি কিন্তু প্লে-লিস্টে নেই! বাংলা ব্যান্ড যদি জনপ্রিয়তাই হারিয়ে থাকে, তা হলে লোক টানতে নিজেদের আয়োজন করা শো-তে বাংলা ব্যান্ডকে ডাকা কেন? তাদের দিয়েই সেই শো-র থিম সং বানানো কেন? এই রহস্যের সমাধান করবে কে?
পরিস্থিতি দেখে কিছুটা আশাহত ‘ফকিরা’ ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট এবং বাংলা ফিল্মে প্লে-ব্যাকের পরিচিত মুখ তিমির বিশ্বাস। তিনি বলছিলেন, ‘গোটা ভারতেই গানবাজনার বাজারটা পাল্টে গিয়েছে। শুধু বাংলা নয়, হিন্দি ব্যান্ড এবং সোলো অ্যালবামের জগতেও ছবিটা একই রকম। মিউজিকের গতিবিধিটাও ফিল্ম প্রোডিউসাররাই ঠিক করে দিচ্ছেন। টাকার লড়াইয়ে ওই প্রোডিউসারদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা প্রায় কোনও ব্যান্ড বা সোলো গায়কেরই নেই।’ তিমিরের সুরেই মুখ খুলেছেন হিন্দি ব্যান্ড ‘ইউফোরিয়া’-র লিড ভোকালিস্ট পলাশ সেন। ‘ধুম’, ‘মায়েরি’, ‘অব না যা’-র মতো একাধিক সুপারহিট গান উপহার দেওয়া গায়ক কিছুদিন আগেই ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। যেখানে মুম্বইয়ের বাজারে ফিল্ম মিউজিকের দাপটে কীভাবে ব্যান্ডগুলোকে কোণঠাসা করে রেখে দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে খুল্লামখুল্লা ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তিনি। কলকাতার ব্যান্ডগুলোও পলাশের সঙ্গে একমত। তারাও বলছে, মুম্বই হোক বা কলকাতা— অর্থশক্তির কাছে তাঁদের হার মানতে হচ্ছে।
চ্যানেল এবং এফ এম স্টেশনগুলোকে ব্যান্ডের গান না চালানো নিয়ে প্রশ্ন করলে, যে জবাবটা তারা দেয়, সেটা হল ব্যান্ডের গান চিৎকার, চেঁচামেচিতে ভরা। সত্যিই কি তাই? উদাহরণ হিসেবে টানা যাক উগ্রতার ‘অভিযোগে’ সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত ফসিল্সের নাম। ‘চক্রব্যূহ’-র মতো কড়াপাকের গান রয়েছে ফসিল্সের ঝুলিতে। আজ থেকে বছর দশেক আগেও কিন্তু সেগুলো এফ এম-এর প্লে লিস্টে নিয়মিত বাজত। লোকে তো শুনতও। সেই ফসিল্সের হাত ধরেই কিন্তু বাংলা ব্যান্ডে ‘মহাকাশ’-এর মতো গানও এসেছে। যা চরম ব্যাতিক্রমী একটি কম্পোজিশন। মজা হচ্ছে, ফসিলসের এবং অন্য ব্যান্ডগুলোর মূলধারার উগ্র গান যেভাবে পৌঁছেছে, নতুন এবং ভিন্নধারার গান কিন্তু পৌঁছয়নি। বলা ভাল পৌঁছে দেওয়া হয়নি। ফলে বঞ্চিত হয়েছেন এফ এম এবং চ্যানেল নির্ভর শ্রোতারাই। এফ এম এবং চ্যানেলের ‘দাদাগিরি’–র বিষয়টা আরও বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন ‘লক্ষ্মীছাড়া’ ব্যান্ডের ড্রামার এবং মহীনের ঘোড়াগুলির গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে গৌরব। তিনি বলছিলেন, ‘বাংলা ফিল্মের রমরমার বাজারে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ‘হিট’ গায়ক-সঙ্গীত পরিচালক অনুপম রায়। তাঁর ফিল্মের গানগুলো যে সুপারহিট সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পাশাপাশি এটাও প্রশ্ন, অনুপমের নন-ফিল্ম গানগুলো কি ততটা প্রচার পেয়েছে?’ গৌরবের ইঙ্গিত স্পষ্টতই অনুপমের ‘বাক্যবাগীশ’, ‘দূরবিনে চোখ রাখব না’ এবং ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর দিকে। খোলামেলা ভাবে গৌরব প্রশ্ন তুলে দিলেন, ‘অনুপম ভাল গান বানাচ্ছে না এমন তো নয়। তা হলে কোন ম্যাজিকে অনুপমের ফিল্মের গানগুলো লোকের মুখে মুখে ঘুরছে, অন্যদিকে ততটা হিট নয় ওর বেসিক অ্যালবামের গানগুলো?’ তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যেতেই পারে, হয়ত গুণগত মানের বিচারে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’— এর মতো ফিল্মি গানের তুলনায় ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ অ্যালবামের ‘রাতপোশাক’-এর গুণগত মান খারাপ। তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন লাইভ শো-তে অনুপম ‘রাতপোশাক’ গাইতে শুরু করলে হাততালিতে ফেটে পড়ে অডিটোরিয়াম? ফসিলসের অফিসিয়াল ফ্যান ক্লাব ‘ফসিলস ফোর্স’। সেই ফ্যান ক্লাবের সক্রিয় সদস্য অর্পণ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘যদি কেউ বলেন বাংলা ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছে, তা হলে তিনি ভুল বলছেন। কারণ আমরা বিভিন্ন ব্যান্ডের শো দেখতে যাই, সেখানে কিন্তু দর্শক- শ্রোতার ভিড়ই আমাদের চোখে পড়ে। ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা কমছে বলে যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা শেষ কবে বাংলা ব্যান্ডের শো-তে গিয়েছেন? শেষ কটা বাংলা ব্যান্ডের গান শুনেছেন? সমালোচনা করার আগে অন্তত পাঁচটা নতুন-পুরনো ব্যান্ডের গান শুনে এবং লাইভ–শো দেখে আসাটা উচিত নয় কি? সেটা না দেখে-শুনেই যদি কেউ সমালোচনা করতে বসেন, তা হলে সেটা দুর্ভাগ্যজনক।’ শুধু তাই নয়, গত ১৩ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের আগে ফসিলস, চন্দ্রবিন্দুদের নিয়ে যে কনসার্ট আয়োজন করেছিল একটি এফ এম স্টেশন, সেখানে প্রত্যাশার প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক দর্শক এসেছিলেন। ঢুকতেই দেওয়া যায়নি সকলকে। বাংলা ব্যান্ডের জন্য শ্রোতা যদি নাই থাকেন, তা হলে শো-তে ঢোকার লাইনে যাঁরা তিন ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেও ফিরে গেলেন, তাঁরা কারা?
বাংলায় সর্বাধিক জনপ্রিয় মিউজিক চ্যানেলটি পরিচিতি পেয়েছিল বাংলা ব্যান্ডের হাত ধরেই। ২০০৬ এবং ২০০৭ সালে ‘ব্যান্ড-এ-মাতরম্’ এবং ‘ব্যান্ড-এ-মাতরম্ ২’ নামে ওই ‘ব্যান্ড ট্যালেন্ট হান্ট’ শো-তে অংশ নিয়েছিল প্রায় দু’শোরও বেশি ব্যান্ড। সেখান থেকেই উঠে এসেছিল ঈশান, পৃথিবী, মিসিং লিঙ্কের মতো শক্তিশালী ব্যান্ড। সুপারহিট হওয়া সত্ত্বেও কেন তৃতীয় বছরে সেই শো বন্ধ হয়ে গেল, সেটা বলতে পারেন না কেউই। যে সদ্যোজাত চ্যানেল সেই ‘ব্যান্ড-এ-মাতরম্’–কে হাতিয়ার করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল, সেখানে রমরমিয়ে বাজে বিশেষ একটি প্রোডাকশন হাউসের ফিল্মের গান। কট্টর ব্যান্ডভক্তদের মতে, এটা স্রেফ বেইমানি। তাঁরা বলছেন, ‘যে ঘরানার গানবাজনাকে হাতিয়ার করে ওই চ্যানেলগুলো বিখ্যাত হল, আজ সেই ব্যান্ড মিউজিককেই ঝেড়ে ফেলেছে তারা।’
আর বাংলার জনপ্রিয়তম ব্যান্ড ফসিল্স কী বলছে? রূপম ইসলামের আক্ষেপ, ‘নতুন শিল্পীদের উঠে আসার রাস্তা ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় কোনও প্ল্যাটফর্মই নেই। কেউ যদি কপালগুণে কোনও পরিচালকের নজরে পড়ে যায় তা হলেই শুধু নতুন শিল্পীর উঠে আসার জায়গা আছে।’ রূপম বলছিলেন, ‘রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলের স্লট পয়সা দিয়ে কিনে নেওয়া হচ্ছে। কলকাতার বাজারে এক বা দু’জন ব্যক্তি সেই স্লটগুলো কিনে নেন।’ আর ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা কমার তত্ত্বও ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন রূপম। তিনি বলছেন, ‘২০০৩ থেকে বাংলা গানবাজনার জগতে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক একটি বাংলা ব্যান্ডই পায়। এখনও সেই ছবি বদলায়নি।’ রূপমের ইঙ্গিত স্পষ্টতই তাঁর নিজের ব্যান্ড ফসিল্সের দিকে। তাঁদের লাইভ শো-তে উপচে পড়া ভিড়ও কিন্তু প্রমাণ করে দেয় বাংলা ব্যান্ড সচেতন শ্রোতাদের কাছে এখনও সমান জনপ্রিয়।
কথায় কথায় রূপম জানালেন, স্লট কিনে শ্রোতাদের যে জোর করে শুধুমাত্র ফিল্ম মিউজিক শোনানোর ফন্দি আঁটা হচ্ছে, এটা কোনও কষ্টকল্পিত ধারণা নয়। তার প্রমাণও আছে। কী সেই প্রমাণ? নতুন– পুরনো সমস্ত বাংলা ব্যান্ডের কাজ সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে রূপমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘বাংলা রক ম্যাগাজিন’। সম্প্রতি সেই পত্রিকার এক প্রতিবেদনে ফাঁস হয়েছে চমকে দেওয়ার মতো পরিসংখ্যান। বাংলা রক ম্যাগাজিন জানাচ্ছে, রেডিও সমীক্ষাকারী সংস্থা এয়ার চেক ইন্ডিয়ার হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ১১ মে থেকে ১৮ মে পর্যন্ত সাত দিনে শহরের সবকটা এফ এম চ্যানেলে মোট ১৯,০০০-এর বেশি গান বেজেছে। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ হিন্দি গান, ৩৩% বাংলা গান, ২% ভক্তিমূলক এবং ১% ইংরেজি গান। খোদ কলকাতার বুকে রেডিও স্টেশনগুলোতেই বাংলা গানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক হিন্দি গান বাজানো হয়। তারমধ্যে একই গান বারংবার বাজানোর ঘটনাও আছে। রেডিও ব্যবসায় যাকে বলে হ্যামারিং থিওরি। অর্থাৎ কোনও একটা গানকে বারবার শুনিয়ে, জোর করে শ্রোতাদের মগজে গেঁথে দেওয়া। কোনও খারাপ গানও সকাল-দুপুর-রাত প্রতিদিন নিয়মিত বাজানো হলে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর মানুষ সেই গান গুনগুন করতে বাধ্য।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিদিন, নিয়মিত মানে কী? এমন অনেক গান আছে, যেগুলো এক সপ্তাহে ২০০-৩০০ বার বেজেছে। একটা সিনেমার গানকে এই সাত দিনে সমস্ত এফ এম চ্যানেলে বাজানো হয়েছে ৩৮০ বার, প্রতিদিন গড়ে ৫৪ বারেরও বেশি। মানে গড়ে ঘণ্টায় আড়াইবারেরও বেশি! গান হিট করানোর জন্য এই হ্যামারিং থিওরি যে মোক্ষম দাওয়াই, সেটা মেনে নিচ্ছেন মনোবিদরাও। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অম্লানকুসুম জানা বলছেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কোনও গান বারবার চালালে একটা সময়ের পরে লোকে নিজে থেকেই সেটা গুনগুন করতে থাকে। গানটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। খুব ভাল গান একবার শুনলেই ভাল লেগে যায়। তেমনই খারাপ বা মাঝারি গান ভাল লাগানোর জন্য বারবার চালাতে হয়। পাশাপাশি সেটা বেশি লোকের কাছেও পৌঁছে যায়।’ জনপ্রিয় প্রোগ্রেসিভ রক ব্যান্ড ‘ঈশান’-এর ভোকালিস্ট সায়নও বলছিলেন, ‘গানকে হিট করানোর ক্ষেত্রে এই হ্যামারিং থিওরি খুবই কার্যকর।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই মুহূর্তে কি নতুন ভাল বাংলা গান তৈরি করছে না ব্যান্ডগুলো? নাকি সেগুলো শোনার অধিকার নেই শ্রোতাদের। ধরে নেওয়া যাক সেই অনুপম রায়ের কথাই। কিছুদিন আগেই অনুপম এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এক নতুন গীতিকার-গায়কের কথা। প্রাঞ্জল দাস। ‘ব্যাড ট্রিপ’ ব্যান্ডের এই লিড ভোকালিস্টকে অনুপম চিহ্নিত করেছিলেন অন্যতম সেরা প্রতিভাবান হিসেবে। কিংবা সুদীপ্ত দাস। কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া ফিল্ম ‘নকশাল’-এ সুদীপ্তর গলা শোনা গিয়েছে। গতবছর একটি শো-তে রূপম ঘোষণা করে দিয়েছেন, ভবিষ্যতের বাংলা গানের সেরা মুখ হওয়ার মশলা সুদীপ্তর কলম আর গলায় আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাঞ্জল-সুদীপ্তদের মতো প্রতিভাবান আরও যাঁরা, তাঁদের গান শোনার জন্য তো কোনও রাস্তাই খোলা থাকছে না। রূপম-অনুপমরা যাঁদের মধ্যে ভবিষ্যতের সেরা হওয়ার উপাদান পাচ্ছেন, সেই মুখগুলো কি এতটাই ফেলনা? একইভাবে আড়ালে থেকে যাচ্ছে, ‘শুঁয়োপোকা’, ‘রোড রোলার’, ‘ব্যাড ট্রিপ’, ‘ভারতবর্ষ’-র মতো ব্যান্ডগুলো।
এই পরিস্থিতিতে লড়ছে একা ‘রেডিও বাংলা রক’। এই ইন্টারনেট রেডিও স্টেশনটি নিয়ম করে বাংলা ব্যান্ড এবং সোলো শিল্পীদের গান বাজিয়ে যাচ্ছে। সেখানে বিখ্যাত থেকে কম খ্যাতিসম্পন্ন— বাদ পড়ছে না কারও গানই। ভাল লাগলে শুনুন। জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বাজারি ফর্মুলায় নিজেদের জড়িয়ে ফেলেনি তারা। পাশাপাশি, সামান্য হলেও আশার কথা এই যে, কিছুটা হলেও গত তিন-চার বছরে ফকিরা কিংবা এলিয়েনজের মতো ব্যান্ড কিন্তু জনপ্রিয়তার শিখরে উঠছে। ফকিরার প্রথম অ্যালবাম ‘ইতরপনা’ ইতিমধ্যেই সুপারহিট! মন্দার বাজারেও রমরমিয়ে বিক্রি হয়েছে। কিংবা ধরা যাক এলিয়েনজের নতুন অ্যালবাম ‘জরিমানা’। ব্যান্ডের ঠান্ডা বাজারেও কিন্তু ‘জরিমানা’ ভালই বিক্রি হয়েছে। এই অ্যালবামে ‘ব্যাখ্যা হয় না’, ‘আজ কোথাও’-এর মতো গানগুলো নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। খুব প্রত্যাশিতভাবেই কিন্তু আবারও সেই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। কেন ফকিরার ‘নিজামুদ্দিন’ কিংবা এলিয়েনজের ‘জরিমানা’ এফ এম-এ শোনা যাচ্ছে না? জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, কলকাতার যে কোনও এফ এম স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই তারা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে। সাফ বলে দিচ্ছে, কী ধরনের গান বাজবে, সেগুলো এখানে ঠিক হয় না। মার্কেট পলিসি সদর দপ্তর থেকে ঠিক হয়ে আসে। সদর দপ্তর অর্থাৎ মুম্বই, হায়দরাবাদ, দিল্লির মতো শহর। বাঙালির কান, বাঙালির গান আর নিজের হাতে নেই। কেউ কেউ রসিকতার সুরে বলছেন, দাউদ ইব্রাহিম যেমন করাচিতে বসে মুম্বইকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেরকমই ‘মাফিয়া মিডিয়া’ দেশের অন্য শহর থেকে দাপটের সঙ্গে ছড়ি ঘোরাচ্ছে কলকাতার গানপ্রেমীদের ওপরে।
ব্যক্তিগত পরিচিতির সুবাদে এখনও কথা, দেখা, আড্ডা হয় বাংলা ব্যান্ড-উৎসাহীদের সঙ্গে। দু-একটা আলোচনার পরেই কথায় কথায় উঠেও আসে ব্যান্ডের স্বর্ণযুগের কথা। সঙ্গে সঙ্গেই জ্বলজ্বল করে ওঠে তাঁদের কারও কারও চোখ। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নড়েচড়ে বসেন তাঁরা। বলতে শুরু করেন, ‘সে এক সময় ছিল বটে...!’
ঋণ: বাংলা রক ম্যাগাজিন, সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী
ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘লাভ ইট অর হেট ইট, বাট ইউ কান্ট ইগনোর ইট’। বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ক্ষেত্রেও কিন্তু সেই কথাটা খাটে। নিন্দুকেরা বলতেই পারেন, বাংলা ব্যান্ডের সে পুরনো জৌলুস আর নেই। সত্যিই কি তাই? বাজারি প্রচারের মাপকাঠিতে যদি ধরা হয়, তা হলে আপাতদৃষ্টিতে এরকমটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। ১৯৯৮-’৯৯ থেকে শুরু করে বাংলা ব্যান্ড জাঁকিয়ে বসেছিল কলকাতা–সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে।
ব্যান্ড ছাড়া কলেজ ফেস্ট? ভাবাই যেত না। একটা সময় ছিল, যখন পাঁচটা সংস্কৃতিমনস্ক ছেলে এক জায়গায় হলে লিটল ম্যাগাজিন বের করার কথা ভাবত। নব্বইয়ের শেষে এবং দু’হাজারের শুরুর দিকে সেভাবেই পাঁচজন সংস্কৃতিমনস্ক এক জায়গায় হলেই তৈরি হয়েছে ব্যান্ড। তার সবকটাই যে বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে এমন নয়। তবে আবার বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখেছে, এমন ব্যান্ডের সংখ্যাও কম নয়। না হলে কেনই বা ব্যান্ড-এ-মাতরম্ কিংবা ব্যান্ডওয়াগনের মতো শো-গুলো আয়োজন করবে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল? কেন বাংলা ব্যান্ডের গান নিয়ে আলাদা ‘স্লট’ রাখবে কলকাতার এফ এম স্টেশনগুলো? তার মানে কিছু নিশ্চয়ই ছিল ব্যান্ডের গানে। তা হলে ছবিটা পাল্টাল কেন?
সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একটু চোখ রাখা যাক বাংলা ব্যান্ডগুলোর কনসার্টের দিকে। খুব কম কনসার্টই আছে, যেখানে বাংলার প্রথম সারির ব্যান্ড পারফর্ম করতে উঠলে হাউসফুল বা প্রায় হাউসফুল ভিড় হয় না। এই ২০১৬-তে (যে সময়টাকে বাংলা ব্যান্ডের মন্দার বাজার বলা হচ্ছে) এসেও অডিটোরিয়াম উপচে পড়া ভিড় কীসের ইঙ্গিত দেয়? জনপ্রিয়তা ছাড়া কীভাবে ব্যাখ্যা করব এই ছবিকে, যেখানে স্টেজে উঠে জনপ্রিয় ব্যান্ডের জনপ্রিয়তম গায়ক যখন হুঙ্কার ছাড়েন, ‘বসে বসে রক শো হয় না’ তখন ব্যারিকেড ভেঙে হুড়মুড়িয়ে স্টেজের সামনে চলে আসেন দর্শক-শ্রোতারা। নিজের চোখে এই দৃশ্যগুলো দেখলে কেউই বলতে পারবেন না, যে বাংলা ব্যান্ড জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। আসলে যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে বাংলা বেসিক অ্যালবাম (যা সাধারণভাবে সোলো অ্যালবাম নামেও পরিচিত) এবং বাংলা ব্যান্ডকে একঘরে করে রেখেছে রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো।
১০-১৫ বছর আগের কথা ভাবুন। বাংলা ফিল্মের গানের পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়ে মিউজিক চ্যানেল এবং এম এম স্টেশনগুলোতে নিয়মিত বাজানো হত। রমরমিয়ে চলতও সেগুলো। তখনও ইন্টারনেট এবং ইউটিউবের এতটা বাড়বাড়ন্ত হয়নি। শুনতে চাই বললেই দুম করে পছন্দের ব্যান্ডের গান ডাউনলোড করে শুনে নেওয়া যেত না। ভরসা তাই সেই এফ এম আর টিভি চ্যানেলগুলোই। অজস্র শ্রোতা হাপিত্যেশ করে থাকতেন কখন সঙ্গীত বাংলায় ‘একলা ঘর’-এর নতুন ভিডিওটা দেখাবে। কখন রেডিও মির্চির বিশেষ শো ‘বেতার মির্চি’-তে ‘লক্ষ্মীছাড়া’ আনপ্লাগড গাইবে ‘জীবন চাইছে আরও বেশি’। ওই একই শো-তে ফসিলস এপিসোড তো ব্যান্ড ইতিহাসের লোকগাথায় ঢুকে গেছে। সেসময় এফ এম আর টিভি চ্যানেলগুলোতে নিয়ম করে বাজানো হত কবীর সুমন, মৌসুমি ভৌমিক, নচিকেতাদের গান। সঙ্গে অবশ্যই বাংলা ব্যান্ড। কিন্তু যত দিন এগিয়েছে, ততই এফ এম স্টেশন আর মিউজিক চ্যানেলগুলোতে জাঁকিয়ে বসেছে ফিল্মের গান। এই মুহূর্তে ফিল্মের গানের বাড়বাড়ন্তের কারণটা এক ‘ওপেন সিক্রেট’। রেডিও কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলের অন্দরমহলে খোঁজ নিলেই জানা যায়, ফিল্ম প্রোডাকশন হাউসগুলো কীভাবে তাদের হাতের পুতুল করে রেখেছে। কলকাতা শহরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি রেডিওকর্মীর আক্ষেপ, তাঁরা কবীর সুমন, নচিকেতাদের পাশাপাশি বাংলা ব্যান্ডের গানও সমান গুরুত্ব দিয়ে বাজাতে চান। কিন্তু সেই অনুমতি কর্তৃপক্ষ দেন না। বরং প্লে-লিস্টে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ফিল্মের গান। কারণ, নিজেদের ফিল্মের গান বাজানোর শর্তে আগে থেকেই ‘স্লট’ কিনে রেখেছে প্রোডাকশন হাউসগুলো। ফলে ব্যান্ডের জন্য সময় নেই।
কলকাতার এক নামজাদা রেডিও জকি বলছিলেন, ‘গানও এখন অনেকটাই বাজারের আর পাঁচটা পণ্যের মতোই। বাজারে নতুন পণ্য আনার আগে তার বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটিংয়ের ওপরে জোর দেওয়া হয়। গানের মার্কেটিংটা হয় এফ এম স্টেশনে বারবার বাজিয়ে সেটাকে সুপরিচিত করে তোলার মাধ্যমে। মুম্বইয়ের গানের বাজারে এই ফর্মুলা অনেক আগেই প্রয়োগ করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ভাবে সেটা সফলও হয়েছে। শ্রোতারা কোন গান শুনবেন, অর্থের জোরে সেটা ঠিক করে দিচ্ছেন অর্থবান প্রোডিউসাররা। ফলে তাঁদের প্রযোজনা করা ফিল্মের গানই বারবার বাজছে রেডিও স্টেশনে। এবার বোধহয় কলকাতার পালা। আস্তে আস্তে কলকাতার রেডিও স্টেশনগুলোও ফিল্মের প্রোডিউসারদের হাতের পুতুল হয়ে যাবে। তখন ইচ্ছে না থাকলেও আমাদের বাংলা ব্যান্ড বা কবীর সুমনের গান না বাজিয়ে, যতই বলো আমায় বোকা ভোলা, কাল হবি তুই আমার কোকাকোলা— জাতীয় গান বাজাতে হবে।’ একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, কলকাতায় একটা রেডিও স্টেশন ইতিমধ্যেই ১০০ শতাংশ হিন্দি গান বাজাতে শুরু করেছে। ১০০ শতাংশ হিন্দি গান— অর্থাৎ কলকাতার বুকে ব্যবসা করতে নেমেও একটিও বাংলা গান প্লে-লিস্টে না রাখার সিদ্ধান্ত! বাংলা গানকে ব্রাত্য করে দেওয়ার এই প্রচেষ্টা কতটা সমর্থনযোগ্য, সে বিচার শ্রোতারাই করবেন। তবে মজার তথ্য হচ্ছে, এই স্টেশনগুলোই যখন স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করতে একটি লাইভ শো-র আয়োজন করে, তখন ডাক পড়ে সেই প্লে-লিস্টে ব্রাত্য থাকা বাংলা ব্যান্ডগুলোরই। তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে, ফসিলস, ক্যাকটাস, চন্দ্রবিন্দুদের গান অনুষ্ঠানে বাজানো যায় না। কিন্তু তাদের আয়োজন করা লাইভ–শো সুপারহিট করতে বাংলা ব্যান্ডেরই শরণাপন্ন হতে হয়। এরপরেও যখন কোনও এফ এম চ্যানেলের প্রতিনিধি বলে দেন, ‘বাংলা ব্যান্ড জনপ্রিয়তা হারিয়েছে’, তখন বিষয়টা ‘ধাঁধার চেয়েও জটিল’ বলেই মনে হয়। স্টেজ শো-তে আছি কিন্তু প্লে-লিস্টে নেই! বাংলা ব্যান্ড যদি জনপ্রিয়তাই হারিয়ে থাকে, তা হলে লোক টানতে নিজেদের আয়োজন করা শো-তে বাংলা ব্যান্ডকে ডাকা কেন? তাদের দিয়েই সেই শো-র থিম সং বানানো কেন? এই রহস্যের সমাধান করবে কে?
পরিস্থিতি দেখে কিছুটা আশাহত ‘ফকিরা’ ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট এবং বাংলা ফিল্মে প্লে-ব্যাকের পরিচিত মুখ তিমির বিশ্বাস। তিনি বলছিলেন, ‘গোটা ভারতেই গানবাজনার বাজারটা পাল্টে গিয়েছে। শুধু বাংলা নয়, হিন্দি ব্যান্ড এবং সোলো অ্যালবামের জগতেও ছবিটা একই রকম। মিউজিকের গতিবিধিটাও ফিল্ম প্রোডিউসাররাই ঠিক করে দিচ্ছেন। টাকার লড়াইয়ে ওই প্রোডিউসারদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা প্রায় কোনও ব্যান্ড বা সোলো গায়কেরই নেই।’ তিমিরের সুরেই মুখ খুলেছেন হিন্দি ব্যান্ড ‘ইউফোরিয়া’-র লিড ভোকালিস্ট পলাশ সেন। ‘ধুম’, ‘মায়েরি’, ‘অব না যা’-র মতো একাধিক সুপারহিট গান উপহার দেওয়া গায়ক কিছুদিন আগেই ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। যেখানে মুম্বইয়ের বাজারে ফিল্ম মিউজিকের দাপটে কীভাবে ব্যান্ডগুলোকে কোণঠাসা করে রেখে দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে খুল্লামখুল্লা ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তিনি। কলকাতার ব্যান্ডগুলোও পলাশের সঙ্গে একমত। তারাও বলছে, মুম্বই হোক বা কলকাতা— অর্থশক্তির কাছে তাঁদের হার মানতে হচ্ছে।
চ্যানেল এবং এফ এম স্টেশনগুলোকে ব্যান্ডের গান না চালানো নিয়ে প্রশ্ন করলে, যে জবাবটা তারা দেয়, সেটা হল ব্যান্ডের গান চিৎকার, চেঁচামেচিতে ভরা। সত্যিই কি তাই? উদাহরণ হিসেবে টানা যাক উগ্রতার ‘অভিযোগে’ সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত ফসিল্সের নাম। ‘চক্রব্যূহ’-র মতো কড়াপাকের গান রয়েছে ফসিল্সের ঝুলিতে। আজ থেকে বছর দশেক আগেও কিন্তু সেগুলো এফ এম-এর প্লে লিস্টে নিয়মিত বাজত। লোকে তো শুনতও। সেই ফসিল্সের হাত ধরেই কিন্তু বাংলা ব্যান্ডে ‘মহাকাশ’-এর মতো গানও এসেছে। যা চরম ব্যাতিক্রমী একটি কম্পোজিশন। মজা হচ্ছে, ফসিলসের এবং অন্য ব্যান্ডগুলোর মূলধারার উগ্র গান যেভাবে পৌঁছেছে, নতুন এবং ভিন্নধারার গান কিন্তু পৌঁছয়নি। বলা ভাল পৌঁছে দেওয়া হয়নি। ফলে বঞ্চিত হয়েছেন এফ এম এবং চ্যানেল নির্ভর শ্রোতারাই। এফ এম এবং চ্যানেলের ‘দাদাগিরি’–র বিষয়টা আরও বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন ‘লক্ষ্মীছাড়া’ ব্যান্ডের ড্রামার এবং মহীনের ঘোড়াগুলির গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে গৌরব। তিনি বলছিলেন, ‘বাংলা ফিল্মের রমরমার বাজারে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ‘হিট’ গায়ক-সঙ্গীত পরিচালক অনুপম রায়। তাঁর ফিল্মের গানগুলো যে সুপারহিট সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পাশাপাশি এটাও প্রশ্ন, অনুপমের নন-ফিল্ম গানগুলো কি ততটা প্রচার পেয়েছে?’ গৌরবের ইঙ্গিত স্পষ্টতই অনুপমের ‘বাক্যবাগীশ’, ‘দূরবিনে চোখ রাখব না’ এবং ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর দিকে। খোলামেলা ভাবে গৌরব প্রশ্ন তুলে দিলেন, ‘অনুপম ভাল গান বানাচ্ছে না এমন তো নয়। তা হলে কোন ম্যাজিকে অনুপমের ফিল্মের গানগুলো লোকের মুখে মুখে ঘুরছে, অন্যদিকে ততটা হিট নয় ওর বেসিক অ্যালবামের গানগুলো?’ তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যেতেই পারে, হয়ত গুণগত মানের বিচারে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’— এর মতো ফিল্মি গানের তুলনায় ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ অ্যালবামের ‘রাতপোশাক’-এর গুণগত মান খারাপ। তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন লাইভ শো-তে অনুপম ‘রাতপোশাক’ গাইতে শুরু করলে হাততালিতে ফেটে পড়ে অডিটোরিয়াম? ফসিলসের অফিসিয়াল ফ্যান ক্লাব ‘ফসিলস ফোর্স’। সেই ফ্যান ক্লাবের সক্রিয় সদস্য অর্পণ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘যদি কেউ বলেন বাংলা ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছে, তা হলে তিনি ভুল বলছেন। কারণ আমরা বিভিন্ন ব্যান্ডের শো দেখতে যাই, সেখানে কিন্তু দর্শক- শ্রোতার ভিড়ই আমাদের চোখে পড়ে। ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা কমছে বলে যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা শেষ কবে বাংলা ব্যান্ডের শো-তে গিয়েছেন? শেষ কটা বাংলা ব্যান্ডের গান শুনেছেন? সমালোচনা করার আগে অন্তত পাঁচটা নতুন-পুরনো ব্যান্ডের গান শুনে এবং লাইভ–শো দেখে আসাটা উচিত নয় কি? সেটা না দেখে-শুনেই যদি কেউ সমালোচনা করতে বসেন, তা হলে সেটা দুর্ভাগ্যজনক।’ শুধু তাই নয়, গত ১৩ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের আগে ফসিলস, চন্দ্রবিন্দুদের নিয়ে যে কনসার্ট আয়োজন করেছিল একটি এফ এম স্টেশন, সেখানে প্রত্যাশার প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক দর্শক এসেছিলেন। ঢুকতেই দেওয়া যায়নি সকলকে। বাংলা ব্যান্ডের জন্য শ্রোতা যদি নাই থাকেন, তা হলে শো-তে ঢোকার লাইনে যাঁরা তিন ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেও ফিরে গেলেন, তাঁরা কারা?
বাংলায় সর্বাধিক জনপ্রিয় মিউজিক চ্যানেলটি পরিচিতি পেয়েছিল বাংলা ব্যান্ডের হাত ধরেই। ২০০৬ এবং ২০০৭ সালে ‘ব্যান্ড-এ-মাতরম্’ এবং ‘ব্যান্ড-এ-মাতরম্ ২’ নামে ওই ‘ব্যান্ড ট্যালেন্ট হান্ট’ শো-তে অংশ নিয়েছিল প্রায় দু’শোরও বেশি ব্যান্ড। সেখান থেকেই উঠে এসেছিল ঈশান, পৃথিবী, মিসিং লিঙ্কের মতো শক্তিশালী ব্যান্ড। সুপারহিট হওয়া সত্ত্বেও কেন তৃতীয় বছরে সেই শো বন্ধ হয়ে গেল, সেটা বলতে পারেন না কেউই। যে সদ্যোজাত চ্যানেল সেই ‘ব্যান্ড-এ-মাতরম্’–কে হাতিয়ার করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল, সেখানে রমরমিয়ে বাজে বিশেষ একটি প্রোডাকশন হাউসের ফিল্মের গান। কট্টর ব্যান্ডভক্তদের মতে, এটা স্রেফ বেইমানি। তাঁরা বলছেন, ‘যে ঘরানার গানবাজনাকে হাতিয়ার করে ওই চ্যানেলগুলো বিখ্যাত হল, আজ সেই ব্যান্ড মিউজিককেই ঝেড়ে ফেলেছে তারা।’
আর বাংলার জনপ্রিয়তম ব্যান্ড ফসিল্স কী বলছে? রূপম ইসলামের আক্ষেপ, ‘নতুন শিল্পীদের উঠে আসার রাস্তা ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় কোনও প্ল্যাটফর্মই নেই। কেউ যদি কপালগুণে কোনও পরিচালকের নজরে পড়ে যায় তা হলেই শুধু নতুন শিল্পীর উঠে আসার জায়গা আছে।’ রূপম বলছিলেন, ‘রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলের স্লট পয়সা দিয়ে কিনে নেওয়া হচ্ছে। কলকাতার বাজারে এক বা দু’জন ব্যক্তি সেই স্লটগুলো কিনে নেন।’ আর ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা কমার তত্ত্বও ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন রূপম। তিনি বলছেন, ‘২০০৩ থেকে বাংলা গানবাজনার জগতে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক একটি বাংলা ব্যান্ডই পায়। এখনও সেই ছবি বদলায়নি।’ রূপমের ইঙ্গিত স্পষ্টতই তাঁর নিজের ব্যান্ড ফসিল্সের দিকে। তাঁদের লাইভ শো-তে উপচে পড়া ভিড়ও কিন্তু প্রমাণ করে দেয় বাংলা ব্যান্ড সচেতন শ্রোতাদের কাছে এখনও সমান জনপ্রিয়।
কথায় কথায় রূপম জানালেন, স্লট কিনে শ্রোতাদের যে জোর করে শুধুমাত্র ফিল্ম মিউজিক শোনানোর ফন্দি আঁটা হচ্ছে, এটা কোনও কষ্টকল্পিত ধারণা নয়। তার প্রমাণও আছে। কী সেই প্রমাণ? নতুন– পুরনো সমস্ত বাংলা ব্যান্ডের কাজ সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে রূপমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘বাংলা রক ম্যাগাজিন’। সম্প্রতি সেই পত্রিকার এক প্রতিবেদনে ফাঁস হয়েছে চমকে দেওয়ার মতো পরিসংখ্যান। বাংলা রক ম্যাগাজিন জানাচ্ছে, রেডিও সমীক্ষাকারী সংস্থা এয়ার চেক ইন্ডিয়ার হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ১১ মে থেকে ১৮ মে পর্যন্ত সাত দিনে শহরের সবকটা এফ এম চ্যানেলে মোট ১৯,০০০-এর বেশি গান বেজেছে। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ হিন্দি গান, ৩৩% বাংলা গান, ২% ভক্তিমূলক এবং ১% ইংরেজি গান। খোদ কলকাতার বুকে রেডিও স্টেশনগুলোতেই বাংলা গানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক হিন্দি গান বাজানো হয়। তারমধ্যে একই গান বারংবার বাজানোর ঘটনাও আছে। রেডিও ব্যবসায় যাকে বলে হ্যামারিং থিওরি। অর্থাৎ কোনও একটা গানকে বারবার শুনিয়ে, জোর করে শ্রোতাদের মগজে গেঁথে দেওয়া। কোনও খারাপ গানও সকাল-দুপুর-রাত প্রতিদিন নিয়মিত বাজানো হলে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর মানুষ সেই গান গুনগুন করতে বাধ্য।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিদিন, নিয়মিত মানে কী? এমন অনেক গান আছে, যেগুলো এক সপ্তাহে ২০০-৩০০ বার বেজেছে। একটা সিনেমার গানকে এই সাত দিনে সমস্ত এফ এম চ্যানেলে বাজানো হয়েছে ৩৮০ বার, প্রতিদিন গড়ে ৫৪ বারেরও বেশি। মানে গড়ে ঘণ্টায় আড়াইবারেরও বেশি! গান হিট করানোর জন্য এই হ্যামারিং থিওরি যে মোক্ষম দাওয়াই, সেটা মেনে নিচ্ছেন মনোবিদরাও। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অম্লানকুসুম জানা বলছেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কোনও গান বারবার চালালে একটা সময়ের পরে লোকে নিজে থেকেই সেটা গুনগুন করতে থাকে। গানটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। খুব ভাল গান একবার শুনলেই ভাল লেগে যায়। তেমনই খারাপ বা মাঝারি গান ভাল লাগানোর জন্য বারবার চালাতে হয়। পাশাপাশি সেটা বেশি লোকের কাছেও পৌঁছে যায়।’ জনপ্রিয় প্রোগ্রেসিভ রক ব্যান্ড ‘ঈশান’-এর ভোকালিস্ট সায়নও বলছিলেন, ‘গানকে হিট করানোর ক্ষেত্রে এই হ্যামারিং থিওরি খুবই কার্যকর।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই মুহূর্তে কি নতুন ভাল বাংলা গান তৈরি করছে না ব্যান্ডগুলো? নাকি সেগুলো শোনার অধিকার নেই শ্রোতাদের। ধরে নেওয়া যাক সেই অনুপম রায়ের কথাই। কিছুদিন আগেই অনুপম এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এক নতুন গীতিকার-গায়কের কথা। প্রাঞ্জল দাস। ‘ব্যাড ট্রিপ’ ব্যান্ডের এই লিড ভোকালিস্টকে অনুপম চিহ্নিত করেছিলেন অন্যতম সেরা প্রতিভাবান হিসেবে। কিংবা সুদীপ্ত দাস। কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া ফিল্ম ‘নকশাল’-এ সুদীপ্তর গলা শোনা গিয়েছে। গতবছর একটি শো-তে রূপম ঘোষণা করে দিয়েছেন, ভবিষ্যতের বাংলা গানের সেরা মুখ হওয়ার মশলা সুদীপ্তর কলম আর গলায় আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাঞ্জল-সুদীপ্তদের মতো প্রতিভাবান আরও যাঁরা, তাঁদের গান শোনার জন্য তো কোনও রাস্তাই খোলা থাকছে না। রূপম-অনুপমরা যাঁদের মধ্যে ভবিষ্যতের সেরা হওয়ার উপাদান পাচ্ছেন, সেই মুখগুলো কি এতটাই ফেলনা? একইভাবে আড়ালে থেকে যাচ্ছে, ‘শুঁয়োপোকা’, ‘রোড রোলার’, ‘ব্যাড ট্রিপ’, ‘ভারতবর্ষ’-র মতো ব্যান্ডগুলো।
এই পরিস্থিতিতে লড়ছে একা ‘রেডিও বাংলা রক’। এই ইন্টারনেট রেডিও স্টেশনটি নিয়ম করে বাংলা ব্যান্ড এবং সোলো শিল্পীদের গান বাজিয়ে যাচ্ছে। সেখানে বিখ্যাত থেকে কম খ্যাতিসম্পন্ন— বাদ পড়ছে না কারও গানই। ভাল লাগলে শুনুন। জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বাজারি ফর্মুলায় নিজেদের জড়িয়ে ফেলেনি তারা। পাশাপাশি, সামান্য হলেও আশার কথা এই যে, কিছুটা হলেও গত তিন-চার বছরে ফকিরা কিংবা এলিয়েনজের মতো ব্যান্ড কিন্তু জনপ্রিয়তার শিখরে উঠছে। ফকিরার প্রথম অ্যালবাম ‘ইতরপনা’ ইতিমধ্যেই সুপারহিট! মন্দার বাজারেও রমরমিয়ে বিক্রি হয়েছে। কিংবা ধরা যাক এলিয়েনজের নতুন অ্যালবাম ‘জরিমানা’। ব্যান্ডের ঠান্ডা বাজারেও কিন্তু ‘জরিমানা’ ভালই বিক্রি হয়েছে। এই অ্যালবামে ‘ব্যাখ্যা হয় না’, ‘আজ কোথাও’-এর মতো গানগুলো নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। খুব প্রত্যাশিতভাবেই কিন্তু আবারও সেই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। কেন ফকিরার ‘নিজামুদ্দিন’ কিংবা এলিয়েনজের ‘জরিমানা’ এফ এম-এ শোনা যাচ্ছে না? জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, কলকাতার যে কোনও এফ এম স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই তারা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে। সাফ বলে দিচ্ছে, কী ধরনের গান বাজবে, সেগুলো এখানে ঠিক হয় না। মার্কেট পলিসি সদর দপ্তর থেকে ঠিক হয়ে আসে। সদর দপ্তর অর্থাৎ মুম্বই, হায়দরাবাদ, দিল্লির মতো শহর। বাঙালির কান, বাঙালির গান আর নিজের হাতে নেই। কেউ কেউ রসিকতার সুরে বলছেন, দাউদ ইব্রাহিম যেমন করাচিতে বসে মুম্বইকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেরকমই ‘মাফিয়া মিডিয়া’ দেশের অন্য শহর থেকে দাপটের সঙ্গে ছড়ি ঘোরাচ্ছে কলকাতার গানপ্রেমীদের ওপরে।
ব্যক্তিগত পরিচিতির সুবাদে এখনও কথা, দেখা, আড্ডা হয় বাংলা ব্যান্ড-উৎসাহীদের সঙ্গে। দু-একটা আলোচনার পরেই কথায় কথায় উঠেও আসে ব্যান্ডের স্বর্ণযুগের কথা। সঙ্গে সঙ্গেই জ্বলজ্বল করে ওঠে তাঁদের কারও কারও চোখ। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নড়েচড়ে বসেন তাঁরা। বলতে শুরু করেন, ‘সে এক সময় ছিল বটে...!’
ঋণ: বাংলা রক ম্যাগাজিন, সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী